সাপের বাণিজ্যিক চাষ ও সাপের বিষ রফতানির ব্যাপক সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারছে না সরকার। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) রফতানি তালিকায় এ পণ্যের নাম না থাকলেও প্রতি বছর দেশি-বিদেশি চোরাচালান চক্রের মাধ্যমে পাচার হচ্ছে কয়েক কোটি টাকার সাপের বিষ। ভারতসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে সাপের বিষ পাচারের সঙ্গে জড়িত রয়েছে একাধিক চক্র। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাণিজ্যিকভাবে সাপের বিষ রফতানি করে বছরে আয় করা সম্ভব প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। প্রায় দু'বছর আগে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো বিদেশে সাপের বিষ রফতানির বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করে। কিন্তু পরে নানামুখী জটিলতায় এর কার্যক্রম আর বেশিদূর এগোতে পারেনি।
ইপিবি ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সূত্র জানায়, দেশি ও বিদেশি চোরাচালানি চক্র প্রতি বছর কয়েক কোটি টাকার কোবরা (গোখরা) সাপের বিষ পাচার করছে। রফতানির সুযোগ না থাকায় এখন এগুলো পাচার হচ্ছে। পার্শ্বর্বর্তী দেশ ভারত ও ইউরোপের ফ্রান্সে সাপের বিষ পাচার হয়। ঢাকা ও পাবনাকেন্দ্রিক ৫টি চক্র পাচারের কাজে জড়িত। সাপ ও সাপের বিষ মানুষের জন্য ক্ষতিকর হলেও একে বাণিজ্যিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে দেশের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে। সাপের খামার প্রতিষ্ঠা করে সাপ ও সাপের বিষ রফতানি করে দেশের জন্য বছরে ১৫০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কোবরা সাপের বিষ ফার্মাসিউটিক্যালস ও গবেষণাগারের একটি মূল্যবান উপাদান। বিদেশে এর ব্যাপক চাহিদা আছে। দেশের কিছু অসাধু চক্র কোবরা সাপের বিষ সংগ্রহ করে কোটি কোটি টাকায় বিদেশি চক্রের কাছে পাচার করছে।
২০০৮ সালের জুন মাসে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) দেশের এই নতুন সম্ভাবনাময় খাতকে কাজে লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে। ইপিবি এ লক্ষ্যে কোরিয়া, জাপান, চীন, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। এজন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়। সব দেশ থেকে সাপের বিষ বের করার আধুনিক পদ্ধতি এবং যেসব দেশে সাপ একটি সুস্বাদু খাদ্য হিসেবে জনপ্রিয় সেসব দেশের সাপ লালন-পালনকারী খামারের মালিকদের বাংলাদেশে এনে বেসরকারি খাতে যৌথ উদ্যোগে সাপের খামার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু পরে নানামুখী জটিলতায় সে প্রক্রিয়া থেমে আছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, কোবরা সাপের বিষ একটি মূল্যবান রাসায়নিক উপাদান। গবেষণাগারে এর বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে। কোবরা সাপের বিষে পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান পটাশিয়াম সায়ানাইডের পরিমাণ বেশি আছে। বিদেশে পটাশিয়াম সায়ানাইড উৎপাদনের জন্য কোবরা সাপের বিষ ব্যবহার করা হতে পারে। বাংলাদেশে কোবরা সাপের বিষ রাসায়নিক গবেষণাগার বা ওষুধ ফ্যাক্টরিতে ব্যবহার খুব কম হয়। বিদেশে বিশেষ করে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, অস্ট্রিয়া_ যেসব দেশ রাসায়নিক মৌল বা যৌগ উপাদান তৈরি করে তাদের কাছে কোবরা সাপের বিষ খুবই মূল্যবান। কোবরা সাপের (গোখরা) বিষের বিষক্রিয়া বেশি। বাংলাদেশে কোবরা সাপের কোনো খামার গড়ে ওঠেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন রসায়নবিদ জানান, কোবরা সাপের বিষ অনেক রোগের প্রতিষেধক তৈরিতে গবেষণাগারে প্রভাবক ও অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় প্রভাবক ও অনুঘটক হিসেবে কোবরা সাপের বিষ ব্যবহার করা হয়। এ কারণে উন্নত বিশ্বের যেসব দেশ রাসায়নিক উপাদান তৈরি করে, ওইসব দেশে কোবরা সাপের বিষ মূল্যবান। এছাড়া কোবরা সাপের বিষ বায়োকেমিক্যাল (বায়ু জীবাণুযুক্ত অস্ত্র) অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে।
গ্রামবাংলা উন্নয়ন কমিটির একেএম মাকসুদ মনে করেন, সাপ উৎপাদন হতে পারে দেশের অনেক মানুষের জীবিকার অবলম্বন। সাপের বাণিজ্যিক উৎপাদন দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোতে সাপের বিষ একটি মূল্যবান কাঁচামাল। তাই এ দেশে সাপের বিষ উৎপাদন করে তা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর কাছে রফতানি করে শতাধিক কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তিনি আরও বলেন, সাপ বিশ্বব্যাপী রফতানি পণ্য হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশে সাপ পালন ও সাপের বিষ রফতানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এখন ঝালকাঠির সাপুড়ে নুরুল ইসলামকে নিয়ে নতুন করে এগোচ্ছে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো। সাপের বিষ কীভাবে সংগ্রহ করতে হবে, সে সম্পর্কে সাপুড়েদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তিনি বলেন, কুমিরকে ক্যাপটিভ ব্রিডিংয়ের অনুমতি দিলে সাপকে কেন দেওয়া হবে না? এক্ষেত্রে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে দ্রুত অনুমতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের সম্ভাবনাময় এ খাতকে এগিয়ে নিলে বেদে সম্প্রদায়ের কল্যাণের পাশাপাশি দেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ১০০ কোটি ডলারের রফতানি বাজারের উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশ দখল করতে পারবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের ভেতর বিষধর সাপ দংশন করলে তার চিকিৎসার তেমন কোনো সুযোগ ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা বা অনেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেই। বিষধর সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় যে অ্যান্টি-ভেনম ইনজেকশন দরকার তাও উৎপাদন করতে দরকার বিষধর সাপের বিষ। তাই দেশের ভেতরের চাহিদা অনুযায়ী অ্যান্টি-ভেনম ইনজেকশন তৈরিতেও বিদেশের বাজারে তা রফতানি করতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমাণ বিষধর সাপ উৎপাদন ও তা থেকে বিষ আহরণ। ডিম থেকে সাপের বাচ্চা ফোটানো, তাদের লালন-পালন ও তা থেকে বিষ আহরণের কোনো আধুনিক ব্যবস্থা আমাদের দেশে নেই।
No comments:
Post a Comment